টেস্ট ও টি-টোয়েন্টির দুনিয়ায় বাংলাদেশের সংগ্রামের গল্প নতুন কিছু নয়। তবে ওয়ানডে সংস্করণ বাংলাদেশের কাছে ছিল নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের ‘প্রিয়’ মঞ্চ। দেশে কিংবা দেশের বাইরে, এই সংস্করণে বাংলাদেশকে সমীহ করতে বাধ্যই হয় সব প্রতিপক্ষ। সেই দল এখন ওয়ানডেতেও খাবি খাচ্ছে! শারজায় আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের ওয়ানডে সিরিজ হার এই ব্যর্থতার তালিকার সর্বশেষ সংযোজন।
২০২২ সালে তামিম ইকবালের নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে তাদের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জিতে ইতিহাস গড়েছিল বাংলাদেশ। ঐতিহাসিক এই সিরিজ জয়ের পর বাংলাদেশ তার ‘প্রিয়’ ওয়ানডে সংস্করণে আর ধারাবাহিক থাকতে পারেনি। এই সময়ে দেশের মাঠে ভারত ও শ্রীলঙ্কা আর গায়ানায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জয়ের বিপরীতে হেরেছে ৬টিতে। এই ছয় সিরিজের তিনটিই হেরেছে নিজেদের ডেরায়। গত দুই বছরে জিম্বাবুয়ের কাছেও ওয়ানডে সিরিজ হেরেছে বাংলাদেশ। এই সময়ে আফগানিস্তানের কাছেও দুবার ওয়ানডে সিরিজ হেরেছে। শারজায় আফগানদের কাছে সিরিজ হেরে বর্তমানে ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ে একধাপ পিছিয়ে ৯ নম্বরে নেমেছে বাংলাদেশ। ২০০৭ সালে এই সংস্করণে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯। অবধারিত প্রশ্ন, ১৭ বছরে উন্নতি হলো কোথায়?
যে সংস্করণে সবচেয়ে বেশি সফল, সেটিতেও সংগ্রামের পেছনে অনেক কারণ চলে আসবে সামনে। ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা যেমন টানা ছয় বছর নির্বিঘ্নে অধিনায়কত্ব করেছেন, গত দুই বছরে সেটি আর দেখা যায়নি। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে নাটকীয়ভাবে আফগানিস্তান সিরিজের মাঝপথে অবসরের ঘোষণা দেন তামিম ইকবাল। লিটন দাসকে এরপর আপৎকালীন দায়িত্ব দিলেও ২০২৩ এশিয়া কাপের আগে আকস্মিকভাবে সাকিব আল হাসানকে ওয়ানডে সংস্করণের অধিনায়ক করা হয়।
দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা আশায় ছিল, ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে ভারতের চেনা কন্ডিশনে দারুণ কিছুই উপহার দেবেন সাকিবরা। কিন্তু কিসের কী! বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার আগে সাকিবের সেই বিতর্কিত সাক্ষাৎকার। তামিমও নিজের ফেসবুক পেজে বিশ্বকাপ দলে জায়গা না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়ে একটি ভিডিও ছেড়েছিলেন। দেশের দুই তারকা ক্রিকেটার তামিম-সাকিবের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের বেশ বাজে প্রভাব পড়ে বিশ্বকাপে। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং—সব বিভাগেই সাকিব-লিটনদের হতশ্রী পারফরম্যান্সে টানা ৬ ম্যাচ হারের পর ২০২৫ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলার টিকিট বাংলাদেশ কাটতে পারবে কি না, সেই আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল প্রবলভাবে। দিল্লিতে বিতর্কিত ‘টাইমড আউট’ ঘটনার ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে ৩ উইকেটে হারিয়ে পয়েন্ট টেবিলের প্রথম আটে থাকা নিশ্চিত হলে কোনোভাবে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
হতশ্রী বিশ্বকাপের পর রাজনীতিসহ বিভিন্ন কারণে সাকিব অনিয়মিত হয়ে পড়েন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। এ বছরেই বাংলাদেশের তিন সংস্করণে অধিনায়ক হয়েছেন নাজমুল হোসেন শান্ত। তিনিও আর অধিনায়কত্ব করতে ইচ্ছুক নন বলে মাঝে জোর গুঞ্জন। শারজায় তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ খেলতে গেলেও আফগানদের বিপক্ষে অলিখিত ফাইনালে তিনি আর খেলতে পারেননি চোটে পড়ায়। নেতৃত্বের ভারটা বর্তায় মেহেদী হাসান মিরাজের কাঁধে।
ওয়ানডেতে সাম্প্রতিক সময়ে ভরাডুবির মূল কারণ আসলে বাংলাদেশের ধারাবাহিক ব্যাটিং-ব্যর্থতা। ভালো অবস্থান থেকেও ব্যাটিং বিপর্যয় নিয়মিত এক দৃশ্য। হাই স্কোরিং উইকেটে বাংলাদেশ তো ম্যাচ থেকে ছিটকে পড়ে ইনিংস বিরতিতেই। যে স্পিন ছিল মূল শক্তি, সেখানে জাদু কমে গেছে। মাঝে যে পেস বিপ্লব দেখা গিয়েছিল, চোটাঘাতে সেটিও এখন নড়বড়ে। আফগানিস্তান দূরে থাক, বাংলাদেশকে এখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে চোখ রাঙায় নেদারল্যান্ডস-নেপালও!
বাংলাদেশের ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ের অবনমন হতাশাজনক হলেও সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার সুযোগ করে দিয়েছে। আমাদের উন্নতি দরকার; বিশেষ করে ব্যাটিং ধারাবাহিকতা ও ফিনিশিংয়ে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিটি ম্যাচে মনোযোগ ধরে রাখা জরুরি। এখন প্রয়োজন র্যাঙ্কিংয়ের অবনমনকে একটি শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করে শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসা।
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ দল কিছুটা চাপের মধ্যে থাকলেও দলের ক্রিকেটাররা নিজেদের ভুলগুলো শুধরে নিয়ে আরও মনোযোগী হচ্ছে। বিশেষ করে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির আগে র্যাঙ্কিংয়ের অবনমন দলকে বাড়তি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেললেও এটা জয় করতে পারলে আবার আমাদের অবস্থান আগের জায়গায় ফিরে আসবে।
নতুন ক্রিকেটার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে একটি নির্দিষ্ট গ্রুপ নিয়েই চ্যাম্পিয়নস ট্রফি পর্যন্ত এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের পেসাররা ভালো ফর্মে, কিন্তু সমস্যা স্পিনে। মাঝপথে এসে ডিফেন্সিভ বোলিংয়ে যাচ্ছি। আমাদের আক্রমণাত্মক স্পিন বোলিং প্রয়োজন। আমরা একসময় সাতে ছিলাম, সেখান থেকে এগোতে পারিনি, সেটাই ছিল সমস্যা। এমন পরিস্থিতিতে কী বলছেন বাংলাদেশ দলের সাবেক তিন অধিনায়ক।
নতুন ক্রিকেটার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা নয়
হাবিবুল বাশার সুমন, সাবেক অধিনায়ক
নতুন ক্রিকেটার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে একটি নির্দিষ্ট গ্রুপ নিয়েই চ্যাম্পিয়নস ট্রফি পর্যন্ত এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের পেসার ইউনিট ভালো ফর্মে আছে, কিন্তু সমস্যা দেখা দিচ্ছে স্পিন বিভাগে। শুরুতে আমরা আক্রমণাত্মক থাকলেও মাঝপথে এসে ডিফেন্সিভ বোলিংয়ে যাচ্ছি। আমাদের আক্রমণাত্মক স্পিন বোলিং প্রয়োজন। র্যাঙ্কিংয়ে পতন হয়েছে, তবে সেটাই মূল সমস্যা নয়। আমরা একসময় সাতে ছিলাম, সেখান থেকে এগোতে পারিনি, সেটাই ছিল সমস্যা।
র্যাঙ্কিংয়ের অবনমনকে শিক্ষা হিসেবে নিতে হবে
খালেদ মাসুদ পাইলট, সাবেক অধিনায়ক
বাংলাদেশের ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ের অবনমন হতাশাজনক হলেও সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার সুযোগ করে দিয়েছে। আমাদের উন্নতি দরকার; বিশেষ করে ব্যাটিং ধারাবাহিকতা ও ফিনিশিংয়ে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিটি ম্যাচে মনোযোগ ধরে রাখা জরুরি। এখন প্রয়োজন র্যাঙ্কিংয়ের অবনমনকে একটি শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করে শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসা। চ্যাম্পিয়নস ট্রফি সামনে। আর এই সিরিজের অভিজ্ঞতা থেকে শিখে আমরা আরও প্রস্তুত হয়ে সেখানে যেন অংশ নিতে পারি।
বাংলাদেশ দল চাপের মধ্যে আছে
মোহাম্মদ আশরাফুল, সাবেক অধিনায়ক
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ছোট দল বড় দলকে হারাবে, আবার বড় দলও ছোট দলকে হারাবে—এটাই স্বাভাবিক নিয়ম, আর এতে অসম্মানের কিছু নেই।
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ দল কিছুটা চাপের মধ্যে থাকলেও দলের ক্রিকেটাররা নিজেদের ভুলগুলো শুধরে নিয়ে আরও মনোযোগী হচ্ছে। বিশেষ করে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির আগে র্যাঙ্কিংয়ের অবনমন দলকে বাড়তি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেললেও এটা জয় করতে পারলে আবার আমাদের অবস্থান আগের জায়গায় ফিরে আসবে।