জ্যামাইকার স্যাবাইনা পার্কের পড়ন্ত বিকেলে লিটন দাসের সেলফিতে ধরা পড়েছে পুরো দল। বিকেলের সোনালি আলোয় ১১ ক্রিকেটারের মুখ কী যে উজ্জ্বল দেখায় তাতে! খানিক আগেই জ্যামাইকা টেস্টের জয় নিশ্চিত হয়েছে বাংলাদেশের, টেস্টে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে ১৫ বছরের জয়খরা কেটেছে—বাংলাদেশ দলের সবার মুখ সাফল্যের আলোয় উদ্ভাসিত। টানা হারের পর টেস্টে বাংলাদেশ বছরটা শেষ করেছে জয় দিয়ে।
শুধু বছরই নয়, বাংলাদেশের বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের বর্তমান চক্রও শেষ হয়েছে জয় দিয়ে। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের এই চক্র বাংলাদেশ শুরু করেছিল জয় দিয়ে, শেষও হয় জয়ে। মোট ৪ জয়ে এখন দল পয়েন্ট টেবিলের আটে থাকলেও নিঃসন্দেহে এটাই বাংলাদেশের সেরা চক্র। এক চক্রে এত জয় আগের দুটিতে পায়নি বাংলাদেশ। চার জয়ের তিনটিই আবার এসেছে বিদেশের মাঠে। দুটি জয় পাকিস্তানের বিপক্ষে রাওয়ালপিন্ডিতে; আর শেষটি এসেছে পরশু, জ্যামাইকায়। বিদেশের মাঠে বাংলাদেশ এক বছরে এত বেশি জয় আগে কখনো পায়নি। অথচ দেশে সব সময় সমীহজাগানো বাংলাদেশ এ বছর চার টেস্ট খেলে প্রতিটি হেরেছে। প্রতিপক্ষ ছিল শ্রীলঙ্কা-দক্ষিণ আফ্রিকা। পরিসংখ্যান দেখে মনে হতে পারে, বিদেশেই কি বাংলাদেশ বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠল!
বিদেশে বাংলাদেশের সফল হওয়ার সূত্র ছিল, ব্যাটাররা ভালো একটা স্কোর গড়ে দেবেন, আর জয়ের কাজটা সারবেন বোলাররা; বিশেষ করে পেসাররা। পাকিস্তানের সাফল্যের নেপথ্যে পেসারদের অসাধারণ পারফরম্যান্স ছিল। ক্যারিবিয়ায়ও পেসাররা দারুণ বোলিং করেছেন। ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার গতিতে নাহিদ রানার আগুনে বোলিং, তাসকিন আহমেদের বুদ্ধিদীপ্ত বৈচিত্র্যময় বোলিংয়ের সঙ্গে হাসান মাহমুদের সুইং।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের সেরা খেলোয়াড় একজন পেসারই হয়েছেন— তাসকিন। স্পিনাররা প্রয়োজন বুঝে দ্যুতি ছড়িয়েছেন। পাকিস্তানে যেটি নিয়মিত করেছিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ, জ্যামাইকায় বাঁহাতের ভেলকি দেখিয়ে ম্যাচসেরার পুরস্কার জিতে নিয়েছেন তাইজুল ইসলাম। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার, বাংলাদেশ এ বছর যে কয়টি টেস্ট জিতেছে, প্রতিটি দলীয় প্রচেষ্টায়। একক কোনো অত্যাশ্চর্য পারফরম্যান্সের সৌজন্যে জয় আসেনি। সর্বশেষ জ্যামাইকা টেস্টের কথাই ধরুন, এক ম্যাচে কত পারফরমার। ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া, সাদমান ইসলামের ৬৪ ও ৪৬ রানের দুটি ইনিংস, নাহিদ রানার আগুন দেখার পর জাকের আলীর ৯১ রানের ওই কাব্যিক ইনিংস। তাসকিন-হাসানের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের পর দৃশ্যপটের শেষ দিকে তাইজুলের আসা—একটা দলের জেতার এটাই তো সহজ সূত্র।
শুধু দক্ষতায় নয়, বাংলাদেশ ক্যারিবীয়দের হারিয়েছে মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়েও। মাঠে কথার লড়াইয়ে বাংলাদেশ একবিন্দু ছাড় দেয়নি ক্যারিবীয়দের। সাদমান-জাকেরের মতো তরুণেরা কখনো চোখে চোখ রেখে, কখনো রসাত্মক ভঙ্গিতে জবাব দিয়েছেন ক্যারিবীয়দের স্লেজিংয়ের। নাহিদ রানার আগুনের গোলার মতো ধেয়ে আসা শর্ট বলে কিমার রোচের ভেঙে পড়াও তো মনস্তাত্ত্বিক জয় বাংলাদেশের! বিশপ-ওয়ালশরা তাই ‘চাঁপাই এক্সপ্রেসে’র প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন মাইক্রোফোন হাতে। আর এবার ক্যারিবীয় সফরে বাংলাদেশ পেল তাদের নতুন অধিনায়কের সন্ধান, যিনি বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই ‘ক্যাপ্টেন ম্যাটেরিয়াল’, যিনি দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে ভালোবাসেন—যাঁর একটাই দর্শন, ইতিবাচক ভাবনায় দলকে এগিয়ে নেওয়া। আপাতত আপৎকালীন হলেও মেহেদী হাসান মিরাজের ছোট্ট কাঁধে বিসিবি চাইলে লম্বা মেয়াদে দলের ভারটা দিতেই পারে! জ্যামাইকা টেস্ট জিতে মিরাজ বলেছেন, ‘যেহেতু আমি প্রথম অধিনায়কত্ব করছি, এটা আমার বড় একটা পাওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে। সবাই আমাকে খুব সমর্থন দিয়েছে। দলের সবাইকে কৃতিত্ব দিতে চাই। আমি যেভাবে পরামর্শ দিয়েছি, সবাই মেনে নিয়েছে।’
পাকিস্তান সফরের পর গত তিন মাসে টানা হারের বৃত্তে আটকে থাকা বাংলাদেশ ক্যারিবীয় সফরে গিয়ে জয়ের পর আবারও খুঁজে পেয়েছে আত্মবিশ্বাসের জ্বালানি। এই জ্বালানি কাজে লাগিয়ে এখন সাদা বলেও সাফল্যের হাসি নিয়ে দেশে ফেরার সুযোগ বাংলাদেশের।ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ শুরু হচ্ছে ৮ ডিসেম্বর।