ন্যাড়া মাথার সঙ্গে লম্বা গোঁফ–দাড়িতে যে কাউকেই ‘অদ্ভুতুড়ে’ মনে হতে পারে। এর সঙ্গে কেউ যদি চোখ দুটো বড় বড় করে গর্জাতে থাকেন, তাহলে মুখাবয়বে ভয়ংকরই মনে হবে। বর্তমানে বিশ্ব ক্রিকেটে এমন মুখাবয়বের মানুষটির নাম সাজিদ খান। মুলতানে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টে ফিরে আসার নতুন গল্প লিখেছেন পাকিস্তানের এই অফ স্পিনার।
সাজিদ একটি করে উইকেট শিকার করেছেন আর গর্জে উঠেছেন। এরপর বাঁ হাত উঁচিয়ে ধরে ডান হাত দিয়ে ঊরুতে চাপড় (গব্বর সেলিব্রেশন)। একেকটা উইকেটে যেন মিশে আছে ম্যাচের পর ম্যাচ উপেক্ষিত থাকার ক্ষোভের উদ্গিরণ। তা কী করেছেন সাজিদ? ১০ মাস পর টেস্টে পাকিস্তানের একাদশে সুযোগ পেয়েই নিয়েছেন ৭ উইকেট। ২১১/২ থেকে ২৯১ অলআউট—৮০ রানের ব্যবধানে ৮ উইকেট হারিয়ে ইংল্যান্ডও যেন টের পেয়েছে আর যা–ই হোক, সাজিদের বলে ‘বাজবল মুডে’ ব্যাট চালানো সাংঘাতিক ভুল। মুলতানের এই স্পিন সহায়ক পিচে তো একদমই নয়।
৩১ বছর বয়সী সাজিদই এখন পাকিস্তানের প্রথম অফ স্পিনার, যিনি সাকলায়েন মুশতাকের পর দেশের মাটিতে কোনো টেস্টে এক ইনিংসে কমপক্ষে ৫ উইকেট নিয়েছেন।
বাংলাদেশের সাবেক স্পিন বোলিং কোচ সাকলায়েন ২০০০ সালে লাহোর টেস্টের প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই ৮ উইকেট নিয়েছিলেন, যা তাঁর ক্যারিয়ারসেরা বোলিংও। সাজিদ প্রথম ইনিংসে ১১১ রান দিয়ে নিয়েছেন ৭ উইকেট, যা মুলতানে ইনিংসসেরা বোলিং। আগের সেরা ছিল আবরার আহমেদের; ১১৪ রানে ৭ উইকেট। চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, আবরারের অসুস্থতার কারণেই এই টেস্টে খেলতে পারছেন ‘অবহেলিত’ সাজিদ।
মুলতানে কাল ম্যাচের দ্বিতীয় দিনের শেষ সেশনে ৪ উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ডকে এলোমেলো করে দিয়েছিলেন সাজিদ। আজ তৃতীয় দিনের প্রথম সেশনে নিয়েছেন আরও ৩ উইকেট। এর মধ্যে সাজিদের বলে বোল্ড হয়েছেন ৪ ব্যাটসম্যান। টেস্টের এক ইনিংসে পাকিস্তানের কোনো স্পিনারের কমপক্ষে ৪ ব্যাটসম্যানকে বোল্ড করার সর্বশেষ নজির প্রায় ৩৭ বছরের পুরোনো, যখন সাজিদের জন্মই হয়নি। ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে করাচি টেস্টের প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ডেরই ৪ ব্যাটসম্যানকে বোল্ড করেছিলেন প্রয়াত কিংবদন্তি আবদুল কাদির। টেস্টের কোনো দলের প্রথম ইনিংসে এমন ঘটনা সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল ২০১৩ সালে দুবাই টেস্টে, জন্মভূমি পাকিস্তানের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার ইমরান তাহিরের সৌজন্যে।
দেশের মাটিতে টেস্টে জিততে ভুলে যাওয়া পাকিস্তান সাজিদের ছোট্ট ক্যারিয়ারের ‘দ্বিতীয় সেরা’ বোলিংয়ের সৌজন্যেই পৌনে ৪ বছর পর জয়ের স্বপ্ন বুনছে। দ্বিতীয় সেরা—হ্যাঁ। সাজিদের সেরা বোলিং ফিগার কোনটি, তা বাংলাদেশ সমর্থকদের সবচেয়ে ভালো মনে থাকার কথা।
২০২১ সালে বাংলাদেশ–পাকিস্তান মিরপুর টেস্ট। বৃষ্টির কারণে সেই টেস্টে প্রথম তিন দিনে খেলা হয় মাত্র ৬৩.২ ওভার। তখনো পাকিস্তানের প্রথম ইনিংস শেষ হয়নি। চতুর্থ দিন খেলা হয় ৬১.১ ওভার। তখনো বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস শেষ হয়নি। তাই টেস্টের ফল ড্র–ই ধরে নিয়েছিলেন অনেকে। কিন্তু সাজিদের ঘূর্ণিতে শেষ দিনে ফলোঅনে পড়ে বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংসে তিনি নেন ৮ উইকেট। এরপর দ্বিতীয় ইনিংসে নেন আরও ৪ উইকেট। তাতে পাকিস্তান ইনিংস ব্যবধানে মিরপুর টেস্ট জিতে বাংলাদেশকে ২–০ ব্যবধানে ধবলধোলাই করে।
এমন পারফরম্যান্সের পরও পিসিবির নির্বাচকদের মন জিততে পারেননি সাজিদ। ২০২১ সালে সেই মিরপুর টেস্টের পর এটি মাত্র তাঁর পঞ্চম টেস্ট। জীবনের পরতে পরতে এমন বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের পেশোয়ার থেকে উঠে আসা এই স্পিনার খুব অল্প বয়সেই বাবাকে হারান। পরিবার চালাতে তাঁর ভাই রিকশা চালাতেন। আর তিনি একটি ক্রিকেট মাঠে কাজ করতেন। সেখানে ব্যাট মেরামত ও ব্যাটের গ্রিপও লাগিয়ে দিতেন। তখনই ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ জন্মে তাঁর।
কিন্তু সাজিদের কাছে ক্রিকেট সরঞ্জাম কেনার কোনো টাকা ছিল না। তাই নিজের মুঠোফোন বন্ধক রেখে ব্যাট–বল কিনেছিলেন। তবে স্থানীয় কোনো ক্রিকেট দল বা সংগঠকের নজরে পড়েননি। বাধ্য হয়ে নতুন কাজের সন্ধানে দুবাইয়ে চলে যান। ধারদেনা করে ছেলেকে দুবাইয়ে পাঠিয়েছিলেন তাঁর মা।
সাজিদ দুবাইয়ে গিয়ে চাকরি পান বিমানবন্দরে। সেখানে সপ্তাহে ৫ দিন কাজ করতেন আর বাকি ২ দিন ক্রিকেট খেলতেন। কয়েক বছর পর মায়ের ডাকে পাকিস্তানে ফিরে যান। দেশে ফিরে ট্রায়ালে অংশ নিলেও খাইবার পাখতুনখাওয়া দলে সুযোগ মেলেনি।
জীবনে গতিপথ বদলাতে নাকি মাঝে মাঝে এমন কাউকে দরকার পড়ে, যিনি ‘সৌভাগ্যের দূত’ হয়ে আসবেন। সাজিদেরও এমন এক মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়। নাম তাঁর ইমরান খান সিনিয়র। পাকিস্তানের হয়ে ১০টি টেস্ট খেলা ইমরানের সুনজরে পড়েন সাজিদ। ৩৭ বছর বয়সী এ পেসারই খাইবার পাখতুনখাওয়া ক্রিকেট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে সাজিদকে দলে নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। ইমরান তাঁকে এক জোড়া জুতাও উপহার দেন। এভাবেই পেশাদার ক্রিকেটে তাঁর যাত্রা শুরু হয়।
অবহেলিত সেই সাজিদই এখন মুলতান টেস্টে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ওদিকে বেঙ্গালুরু টেস্টে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ভারত নিজেদের মাটিতে সর্বনিম্ন ৪৬ রানে অলআউট না হলে হয়তো আজ সারা দিন তিনি বিশ্ব ক্রিকেটেই হতেন সবচেয়ে আলোচিত নাম।
শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান এই টেস্ট জিততে পারুক বা না পারুক—ফিরে আসার নতুন গল্প লেখার পর সাজিদকে নিশ্চয় আর বাদ দিতে চাইবে না পিসিবি। কাল দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষে সাজিদ যেন সেই কথাটাই পিসিবি অবধি পৌঁছে দিতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, ‘কোনো কারণ ছাড়াই আমাকে দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আমি অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে পারফর্ম করেছি (জানুয়ারিতে সিডনি টেস্টে)। তবু আমাকে বাদ দেওয়া হলো।’ উদ্যাপন নিয়ে তাঁর কথা, ‘আবেগ ও ক্ষোভ থেকেই এই উদ্যাপন। এর মাধ্যমে আমি তাদের ভুল প্রমাণ করতে চেয়েছি।’
নিজেকে যদি কখনো অবহেলিত মনে হয়, তাহলে সাজিদ খানের এই গল্পটা আপনার জন্যই।