গত আগস্টে পাকিস্তানের মাটিতে ঐতিহাসিক টেস্ট জয়, তাও আবার হোয়াইটওয়াশ করার মতো বিরাট অর্জন! সাদা পোশাকে বাংলাদেশের স্মরণকালের সেরা সাফল্য ঢাকা পড়েছিল ভারতে ও দেশের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হোয়াইটওয়াশ হয়ে। ব্যর্থতার ধারাবাহিকতায় হার মানতে হয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়েও। অ্যান্টিগা টেস্টে ২০১ রানের বিশাল হার। এই পাঁচ টেস্টে পরাজয়ের গ্লানি মুছে ফেলে বাংলাদেশ এবার নতুন উচ্চতায়। মঙ্গলবার জ্যামাইকা টেস্টে চতুর্থ দিনেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১০১ রানে হারালো তারা। এই বছর বিদেশের মাটিতে তাদের তৃতীয় জয়- এক বর্ষপঞ্জিকায় তাদের সর্বোচ্চ! ক্যারিবিয়ান দ্বীপে দীর্ঘ জয়খরা কাটিয়ে বছরটিকে স্মরণীয় করে করলো মেহেদী হাসান মিরাজরা।
ওয়েস্ট ইন্ডিজে ১৫ বছরে প্রথম টেস্ট জয় বাংলাদেশের, ২০০৯ সালের পর প্রথম। ক্যারিবিয়ান দ্বীপে টানা সাত টেস্টে হারের পর ব্যাটে-বলে দারুণ পারফর্ম করে সিরিজ ১-১ এ ভাগাভাগি করলো বাংলাদেশ। তাইজুল ইসলাম, জাকের আলী ও নাহিদ রানাদের হাত ধরে তারা লিখলো চমৎকার এক জয়ের চিত্রনাট্য।
বাঁহাতি স্পিনার তাইজুল চতুর্থ ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১৮৫ রানে অলআউট করতে রেখেছেন অসামান্য অবদান। ৫০ রান দিয়ে নিয়েছেন ৫ উইকেট। এটি ছিল তার ১৫তম পাঁচ উইকেট নেওয়ার কীর্তি, বিদেশের মাটিতে চতুর্থ এবং ১০ বছরে ক্যারিবিয়ান দ্বীপে প্রথম। তাসকিন আহমেদ, হাসান মাহমুদ ও নাহিদ নিয়েছেন বাকি পাঁচ উইকেট।
প্রথম ইনিংসে নাহিদ প্রথমবার পাঁচ উইকেট নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১৪৬ রানে গুটিয়ে দেন। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ মাত্র ১৬৪ রান করেও ১৮ রানের লিড পায়। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে তারা ঘুরে দাঁড়ায় দারুণভাবে। জাকের আলী আগ্রাসী ব্যাটিং করেন চতুর্থ দিন। পাল্টা আক্রমণে পাঁচ ছয় ও আট চারে ৯১ রান আসে তার ব্যাটে। এদিন সকালের সেশনে বাংলাদেশের ৭৫ রানের মধ্যে ৬২ রানই করেন তিনি।
জ্যামাইকায় দারুণ শুরু করলেও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচ হাতছাড়া করে। প্রথম ইনিংসে জেইডেন সিলস ১৫.৫ ওভারে মাত্র ৫ রান দিয়ে চার উইকেট নিয়ে বাংলাদেশকে ভোগান। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে তৃতীয় দিন বিকালের সেশনে এই পেসার রান দিয়েছেন হাত খুলে।
চতুর্থ দিন সকালে ২১১ রানের লিড নিয়ে বাংলাদেশ খেলতে নামে। শুরুটা ভালো হয়নি। আলজারি জোসেফের একটি বাউন্সার লাগে জাকেরের হেলমেটে। বাংলাদেশ ফিজিও বেশ কিছুক্ষণ পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তাকে খেলার ছাড়পত্র দেন। কনকাশনের শঙ্কাও উঠেছিল। এরপর বাংলাদেশ দ্রুত কয়েকটি উইকেট হারালে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে।
ষষ্ঠ উইকেটে ৩৪ রান যোগ করার পর তাইজুল ১৪ রানে শর্ট বলে পরাস্ত হন। নিজের চতুর্থ বলে মুমিনুল হক ম্যাচে দ্বিতীয়বার ডাক মারেন। অসুস্থ থাকায় আট নম্বরে ব্যাট করতে নামেন তিনি।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর জাকের আক্রমণে যান। কেমার রোচের বলে জশুয়া ডা সিলভার মাথার ওপর দিয়ে বাউন্ডারি মারেন। তারপর আলজারিকে পুল শট খেলে প্রথম ছক্কা হাঁকান, তাতে প্রথম তিন টেস্টে টানা তৃতীয় ফিফটি উদযাপন করেন। জাকির হাসানের পর দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে এই কীর্তি তার।
পরের দুটি বলেও জাকের চার ও ছয় মারেন। রোচের পরের ওভারে লং অন দিয়ে বল সীমানাছাড়া করেন। শেষ দুই উইকেটে তার লড়াই ছিল দেখার মতো। হাসান মাহমুদ ও তাসকিন আহমেদকে টানা দুই ওভারে ফেরান রোচ। শুধু নাহিদকে নিয়ে সেঞ্চুরি পাওয়ার জন্য লড়েছেন জাকের, শামার জোসেফের এক ওভারে দুটি চার মারেন। তারপর রোচের বলে নিজের চতুর্থ ছক্কা হাঁকান। পঞ্চম ছক্কা মারেন শামারের বলে মিডউইকেট দিয়ে। ওই ওভারেই ৯১ রানে আউট হতে হয়েছে তাকে।
২৮৭ রানের লক্ষ্য দিয়ে তাইজুল ইনিংসের পঞ্চম ওভারে মিকাইল লুইসকে ফেরান। শাহাদাত হোসেন দিপু ডাইভ দিয়ে চমৎকার ক্যাচ নেন।
বাংলাদেশের এই মোমেন্টাম কেড়ে নিতে চেয়েছিলেন ক্রেইগ ব্র্যাথওয়েট। লাঞ্চ ব্রেকের পর কাভার দিয়ে হাসানকে চার মারেন তিনি। লং অন দিয়ে তাইজুলকে মারেন ছক্কা। কিসি কার্টি জ্বলে ওঠার আগেই ১৪ রানে তাসকিনের মিকার হন। তাইজুল ফেরান ব্র্যাথওয়েটকে। মাহমুদুল হাসান জয় স্লিপ থেকে ডানদিকে ঝাঁপিয়ে ক্যাচ নেন। বাংলাদেশি স্পিনার আলিক আথানেজের ব্যাট ও প্যাডের মাঝ দিয়ে স্টাম্প ভাঙেন।
এই বিপর্যয়ের মাঝেও হাল ধরে ছিলেন কাভেম হজ। সময়-সুযোগ বুঝে বাউন্ডারি মেরে রান বাড়াতে থাকেন। তার ব্যাটে দ্বিতীয় সেশনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১১০ রান করে।
শেষ সেশনেও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভালো অবস্থানে ছিল। বিরতির পর প্রথম বলেই ফিফটি করেন হজ। কিছুক্ষণ পরই তাইজুলের নিচু বলে এলবিডব্লিউ হন তিনি।
তাসকিন এরপর নিচু বলে জাস্টিন গ্রিভসের স্টাম্প কাঁপান। জশুয়া ডা সিলভাকে ব্যর্থতার বৃত্তে থাকতে হয়েছে, তাইজুলের কাছে এলবিডব্লিউ হন তিনি।
দ্বিতীয় স্পেলে হাসান মাহমুদকে এনে সাফল্য পায় বাংলাদেশ। এক ওভারে আলজারি ও রোচকে বিদায় করে দলকে জয়ের খুব কাছে নেন। এরপর আসে সেই বড় মুহূর্ত, প্রথম ইনিংসে ম্যাচের গতি পাল্টে দেওয়া নাহিদ দুর্দান্ত ইয়র্কারে শামারকে বোল্ড করেন।
এনিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে তৃতীয়বার টেস্ট জিতলো বাংলাদেশ, যা কোনও একটি দেশে তাদের সর্বোচ্চ। আর বিদেশের মাটিতে এটি তাদের নবম জয়। এর আগে পাকিস্তান ও জিম্বাবুয়েতে দুটি করে টেস্ট জিতেছে বাংলাদেশ। একটি করে নিউজিল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কায়।